ইসলাম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যার অনুসারী সংখ্যা ১.৯ বিলিয়নেরও বেশি। এটি একটি একেশ্বরবাদী আব্রাহামিক ধর্ম যা এর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ রাসূল (প্রেরিত পুরুষ) হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রেরিত চূড়ান্ত প্রত্যাদেশের উপর প্রতিষ্ঠিত।
১. ইসলাম শব্দের অর্থ ও মূল দর্শন
শাব্দিক অর্থ: "ইসলাম" শব্দের আক্ষরিক অর্থ "আত্মসমর্পণ" বা "শান্তি"। এটি আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ এবং তাঁর বিধান মেনে চলার মাধ্যমে আত্মিক ও worldly শান্তি অর্জনকে নির্দেশ করে।
ধর্মতাত্ত্বিক অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাকে "মুসলিম" বলা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূলই ছিলেন মুসলিম, কারণ তারা 모두 এক আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
মূল সাক্ষ্য: ইসলামের মূল ভিত্তি হল "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্" - "আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসূল।" এই সাক্ষ্যই একজন ব্যক্তিকে ইসলামে প্রবেশ করার দরজা হিসেবে কাজ করে।
২. বিশ্বাসের ভিত্তি (ঈমান)
ইসলামে বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ছয়টি, যেগুলোকে "ঈমানের স্তম্ভ" বলা হয়:
১. আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস (তাওহীদ):
- আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো অংশীদার নেই।
- তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী, চিরঞ্জীব ও অনন্য।
- তিনি নিরাকার, তাই তাঁর কোনো প্রতিমূর্তি বা ছবি তৈরি করা যায় না।
- তাওহীদের এই ধারণাই ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু এবং এটি শিরকের (আল্লাহ্র সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা) বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অবস্থান নেয়।
২. ফেরেশতাদের উপর বিশ্বাস (মালাইকা):
- আল্লাহ্ নূর (আলো) দ্বারা সৃষ্ট অদৃশ্য সত্তা যারা তাঁর আদেশ পালন করে।
- গুরুত্বপূর্ণ ফেরেশতাদের মধ্যে রয়েছেন জিবরাইল (আ.) (ওহী বহনকারী), মিকাইল (আ.) (প্রকৃতি ও রিজিকের দায়িত্বে), ইসরাফিল (আ.) (কিয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন) এবং আজরাইল (আ.) (প্রাণ হরণকারী)।
৩. আসমানী কিতাবসমূহের উপর বিশ্বাস:
- ইসলাম বিশ্বাস করে যে আল্লাহ্ মানবজাতির পথনির্দেশনার জন্য বিভিন্ন নবীর উপর কিতাব নাযিল করেছেন।
- প্রধান কিতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- তাওরাত: মুসা (আ.)-এর উপর নাযিলকৃত।
- যাবুর: দাউদ (আ.)-এর উপর নাযিলকৃত।
- ইঞ্জিল: ঈসা (আ.)-এর উপর নাযিলকৃত।
- কুরআন: মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাযিলকৃত, যা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে শেষ ও চূড়ান্ত প্রত্যাদেশ।
৪. নবী-রাসূলগণের উপর বিশ্বাস:
- ইসলাম মতে, আল্লাহ্ মানব ইতিহাস জুড়ে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন, যাদের সবারই মূল বার্তা ছিল তাওহীদ বা এক আল্লাহ্র ইবাদত।
- কুরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে, কিন্তু হাদীস অনুসারে তাদের সংখ্যা লক্ষাধিক।
- পাঁচজন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল বা "উলুল আযম মিনার রাসূল" হলেন: নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) এবং মুহাম্মদ (সা.)। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে "খাতামুন নাবিয়্যিন" বা নবীদের চূড়ান্ত封印 বলে বিশ্বাস করা হয়।
৫. আখিরাত বা পরকালের উপর বিশ্বাস:
- ইসলামে বিশ্বাস করা হয় যে মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। কিয়ামতের দিন সবাইকে পুনরুত্থিত করা হবে এবং তাদের বিশ্বাস ও কর্মের ভিত্তিতে বিচার করা হবে।
- বিচারের পর মানুষ স্থায়ীভাবে জান্নাত (স্বর্গ) বা জাহান্নাম (নরক)-এ প্রবেশ করবে।
- এই বিশ্বাসই মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা সৃষ্টি করে।
৬. তাকদীর বা ভাগ্যের উপর বিশ্বাস:
- মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে ভালো-মন্দ সবকিছুই আল্লাহ্র জ্ঞানে ও ইচ্ছায় ঘটে।
- তবে এই বিশ্বাস মানুষের "ইখতিয়ার" বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে অস্বীকার করে না। মানুষ তার কর্ম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রাখে এবং তার জন্য সে জবাবদিহি হবে।
৩. ইসলামের স্তম্ভ (আরকানুল ইসলাম)
বিশ্বাসের পর এসেছে আমল বা কর্ম। ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি কাজ, যেগুলোকে "ইসলামের স্তম্ভ" বলা হয়:
১. শাহাদাহ (বিশ্বাসের ঘোষণা): "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্" - এই বাক্য উচ্চারণ করে অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা।
২. সালাত (নামাজ): দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নির্দিষ্ট নিয়মে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা। এটি মুসলমানের জন্য আত্মিক সংযোগ ও শৃঙ্খলার প্রতীক।
৩. সাওম (রোজা): রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকা। এটি আত্মসংযম, সহমর্মিতা ও তাকওয়া (আল্লাহ্ভীতি) শিক্ষা দেয়।
৪. জাকাত (দান): নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, তা থেকে每年的 ২.৫% গরিব-অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করা। এটি সামাজিক সুবিচার, সম্পদের পবিত্রতা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে।
৫. হজ্জ: জীবনে once সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য মক্কায় অবস্থিত কাবা শরীফে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র ইবাদত করা। এটি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সমতা ও আত্মসমর্পণের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
৪. পবিত্র কুরআন
মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য: কুরআন ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, যা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর ২৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে নাযিল হয়।
সংরক্ষণ: কুরআন হল একমাত্র আসমানী কিতাব যা সম্পূর্ণরূপে তার মূল ভাষায় (আরবি) সংরক্ষিত আছে, একটি বর্ণও পরিবর্তিত হয়নি। এটি হিফজ (মুখস্থ) করার মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের心中 সংরক্ষিত।
বিষয়বস্তু: এতে রয়েছে তাওহীদের বর্ণনা, নৈতিক নির্দেশনা, বিধি-বিধান, ইতিহাস, পরকালের বর্ণনা এবং বৈজ্ঞানিক কিছু ইঙ্গিত যা আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে।
৫. হাদীস ও সুন্নাহ
হাদীস: হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর言行, অনুমোদন ও বর্ণনা।
সুন্নাহ: তাঁর কর্ম ও জীবনপদ্ধতি।
কুরআনের বাণীকে বাস্তবে রূপদানকারী হলেন রাসূল (সা.)। তাই কুরআন বোঝা ও ইসলামের জীবনব্যবস্থা প্রয়োগের জন্য হাদীস ও সুন্নাহ অপরিহার্য।
সংকলন: বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ – এগুলো是最 গুরুত্বপূর্ণ ও বিশুদ্ধ হাদীস সংকলন (সিহাহ সিত্তাহ)।
৬. ইসলামী আইন (শরীয়াহ) ও ফিকহ
শরীয়াহ: আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। এর উৎস হল কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা (বিদ্বানদের ঐক্যমত্য) ও কিয়াস (সাদৃশ্য)।
ফিকহ: শরীয়াহর বিধি-বিধানকে বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার বিজ্ঞান। এর মাধ্যমে ইবাদত, লেনদেন, পারিবারিক law, ফৌজদারি law ইত্যাদি বিধিবদ্ধ হয়েছে।
মাযহাব: ফিকহশাস্ত্রের within বিভিন্ন বিদ্বানদের ব্যাখ্যা নিয়ে গড়ে উঠেছে প্রধান চারটি মাযহাব বা স্কুল অফ থট: হানাফী, মালিকী, শাফেঈ ও হাম্বলী। এগুলো মূলনীতিতে এক但有 ব্যাখ্যা ও次要 বিধানে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
৭. ইসলামে নৈতিকতা ও আচরণবিধি (আখলাক)
ইসলাম শুধু rituals-এর ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এর নৈতিক শিক্ষাগুলো হলো:
সততা ও সত্যবাদিতা: "সত্য কথা বল, এমনকি তা তিক্ত হলেও।"
দয়া ও করুণা: প্রাণীকূলের প্রতি, বিশেষত পিতা-মাতার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা ফরজ।
ন্যায়বিচার: শত্রুর প্রতিও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা obligatory।
ক্ষমা ও সহনশীলতা: অন্যদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করা এবং ধৈর্য ধারণ করা।
লজ্জা (হায়া): এটি ঈমানের একটি শাখা।
অনুমতি নেওয়া ও সালাম দেওয়া: পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি।
হারাম (নিষিদ্ধ) কাজ থেকে বিরত থাকা: যেমন – মিথ্যা, gossiping, চোগলখোরি, ধোঁকা দেওয়া, চুরি, ডাকাতি, সুদ, জুয়া, ব্যভিচার ইত্যাদি।
৮. ইসলামে নারী ও পরিবার
মর্যাদা: ইসলাম নারীকে মা, কন্যা ও wife হিসেবে前所未有的 মর্যাদা দিয়েছে। জান্নাত মায়ের পায়ের নিচে।
অধিকার: ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকার, শিক্ষা, পেশা ও ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানা সহ বিভিন্ন অধিকার দিয়েছে, যা প্রাক-ইসলামী যুগে nonexistent ছিল।
পরিবার: পরিবার হল ইসলামী সমাজের ভিত্তি। বিবাহ একটি পবিত্র চুক্তি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে相互尊重, দায়িত্ব ও rights-এর ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে উঠে।
পর্দা: নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই শালীন পোশাক ও behavior-এর নির্দেশনা রয়েছে, যার goal হল সমাজের শান্তি ও নৈতিকতা রক্ষা করা।
৯. ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যান্য ধর্ম
ইসলাম "আহলে কিতাব" (কিতাবের লোকজন) অর্থাৎ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিশেষ মর্যাদা দেয়, কারণ তারা earlier নবীদের অনুসারী।
মুসলমানদের指令 হয়েছে: "তোমরা দ্বীন সম্পর্কে যারা তোমাদের সাথে fighting করেনি এবং তোমাদেরকে গৃহচ্যুতও করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে।" (সূরা মুমতাহিনা: ৮)
ইসলাম জবরদস্তি করে ধর্মান্তরকে expressভাবে নিষিদ্ধ করেছে: "দীনে কোনো জবরদস্তি নেই।" (সূরা বাকারা: ২৫৬)
১০. উপসংহার: ইসলামের সার্বজনীন বার্তা
ইসলাম একটি শান্তি, দয়া ও ন্যায়বিচারের ধর্ম। এটি শুধু আখিরাত-কেন্দ্রিক নয়, বরং দুনিয়ার জীবনকেও সুশৃঙ্খল ও meaningful করে তোলার বিধান দেয়। এর মৌলিক শিক্ষা হল এক আল্লাহ্র ইবাদত, সকল নবীর প্রতি বিশ্বাস, মানবতার সেবা এবং একটি নৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ
জীবনযাপন। এটি একটি moderate way of life (উম্মাতান ওয়াসাতান) যার লক্ষ্য হল ব্যক্তি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন।
No comments:
Post a Comment